মাত্র ৬ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে ৬০০০ শিক্ষার্থীতে পৌঁছেছিল USTM তথা মেঘালয় বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু এখন হিমন্ত বিশ্ব শর্মার আক্রমণের পর ভর্তি প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় পতন দেখা যাচ্ছে।
ইউএসটিএম চ্যান্সেলর মাহবুবুল হক আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বিবৃতি দিয়েছেন যে ইউএসটিএম থেকে স্নাতক করা শিক্ষার্থীরা আসামের সরকারি চাকরির জন্য অযোগ্য বিবেচিত হতে পারে। আর এতেই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিবছরের ভর্তির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে ব্যর্থ হতে পারে।
ইউএসটিএম-এর চ্যান্সেলর মাহবুবুল হক মিডিয়াকে দেওয়া এক বিবৃতিতে একথা বলেন। তিনি আরো বলেন, অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার একের পর এক বিবৃতির পর মেঘালয়ের ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি তথা ইউএসটিএম-এর চলমান ভর্তি প্রক্রিয়ায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
তিনি বলেন, শর্মা গত সপ্তাহে বলেছিলেন যে ইউএসটিএম থেকে স্নাতক করা শিক্ষার্থীরা আসামের সরকারি চাকরিতে নিষিদ্ধ হতে পারে। এই বিবৃতির পর USTM এই বছরের ভর্তির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারবে না।
মহবুবুল হক আসামের একজন বাঙালি-মুসলিম। তিনি ইআরডি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা-চেয়ারম্যান। এই ফাউন্ডেশনের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় USTM, কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বিশ্ববিদ্যালয়টি অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার সমালোচনার মুখে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর চ্যান্সেলরের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সমালোচনামূলক মন্তব্য করেছেন হিমন্ত বিশ্ব। শেষ পর্যন্ত হিমন্ত এমন অভিযোগও করেছেন যে ইউএসটিএম-এর ক্যাম্পাস নির্মাণের জন্য গাছ এবং পাহাড় কাটার ফলে গুয়াহাটিতে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে—বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ‘ফ্লাড জিহাদ’ বা “বন্যা জিহাদ” চালানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন মুখ্যমন্ত্রী শর্মা।
হিমন্ত আরও বলেন, তিনটি গম্বুজ বিশিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল গেটের কাঠামো নাকি “মক্কার কাঠামোর মতো”! এটা নাকি “জিহাদের” প্রতীক। তবে এর পরেই হিমন্ত পরামর্শ স্বরূপ বলেন, গেটে মক্কার পাশাপাশি গির্জা ও নামঘরের কাঠামোও থাকা উচিত ছিলো।
মাহবুবুল হক উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, আসামে চাকরির ক্ষেত্রে USTM ফেরত শিক্ষার্থীরা অযোগ্য বিবেচিত হতে পারেন বলে হেমন্ত বিশ্ব শর্মা যে বিবৃতি দিয়েছেন তাতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে নিরুৎসাহ হয়ে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা।
দ্য মাইলস্টোনকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে মহবুবুল হক বলেন, বর্তমানে USTM এ ভর্তি চলছে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর এই বিবৃতির ফলে চলমান ভর্তিতে একটি বিশাল পতন লক্ষ্য করছি। এই বছর আমরা যা আশা করেছিলাম তার থেকে অন্তত প্রায় এক হাজার শিক্ষার্থী কম ভর্তি হবে। তিনি বলেন, আমাদের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী আসাম থেকে আসে। কারণ এটি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় রাজ্য। আসামের গ্রামীণ এলাকার শিক্ষার্থীরা ভাববে যে যদি তাদের ডিগ্রিগুলি সরকারি চাকরির জন্য অযোগ্য হয় তবে তারা তাদের ডিগ্রি নিয়ে কী করবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত বছর বিভিন্ন বিভাগে দুই হাজার দুইশোর অধিক শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিলো। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউশনাল র্যাঙ্কিং ফ্রেমওয়ার্ক অনুযায়ী তারা যথেষ্ট ভালো রেজাল্ট করেছিল। এর ভিত্তিতে এবছর তিন হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী ভর্তির লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করেছিল USTM
আচার্য মহবুবুল হক বলেন, “যেভাবে ভর্তির প্রক্রিয়া প্রথমে চলছিল, তাতে আমরা লক্ষ্য পূরণ করার ব্যাপারে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। কিন্তু গত সপ্তাহ থেকে ভর্তির হার হঠাৎ করে কমে গেছে। এমনকি কোনো দিন কোনো ভর্তিই হয় নি। তবে, ভর্তি প্রক্রিয়া এখনও চলছে এবং আমরা আশা করি এই ভর্তি আবারও গতি পাবে।
USTM পড়ুয়ারা যে চাকরির জন্য আসামে অযোগ্য হতে পারে হিমন্ত বিশ্ব শর্মা গত বুধবার সেই বিবৃতি দিয়েছেন। এই বিবৃতির একমাসও যায়নি, এর মধ্যেই সরকার বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে যে আসাম সরকার ২০২৫ সালের এপ্রিলের মধ্যে পঁয়ত্রিশ হাজার শূন্যপদ পূরণ করবে।
বৃহস্পতিবার মহবুবুল হক বলেন, ইউএসটিএম-এর একটি বড় সংখ্যক শিক্ষার্থী সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করে অর্থাৎ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে।
তিনি বলেন, আমাদের একটি পে-ব্যাক নীতি রয়েছে। যাতে বলা হয়েছে, সেই সব শিক্ষার্থীদের ফি ফেরত দেওয়া হবে যারা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি চাকরি লাভ করবে। ফলে, এই পে- ব্যাক নীতি প্রতি বছর আরও বেশি শিক্ষার্থীকে এই পরীক্ষায় বসতে উৎসাহিত করে।
মহবুবুল হকের কথায়, এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা সরকারি চাকরি পেয়েছে তাদের তথ্য রাখা হয়নি। তবে, এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০০ শিক্ষার্থীকে নেট তথা ইউজিসির-ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি টেস্ট ও এবং গেট তথা গ্র্যাজুয়েট অ্যাপ্টিটিউড টেস্ট ইন ইঞ্জিনিয়ারিং এর মতো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য পুরস্কৃত করেছে।
USTM আচার্য মহবুবুল হক অভিযোগ করে বলেন, আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা তাঁর “টুপি এবং দাড়ি”র জন্য তাঁকে টার্গেট করছেন, কিন্তু বারিদুয়া গ্রামের বাসিন্দারা USTM-কে “মিনি ইন্ডিয়া” হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, USTM-এর ৯৫ শতাংশ শিক্ষক এবং ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অন্য সম্প্রদায়ের। এর মধ্যে রয়েছেন ৩০টি উপজাতিসহ ৩৯টি ভিন্ন সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থী।
মহবুবুল হক আক্ষেপ করে মাইলস্টোনকে বলেন, আমি মহবুবুল হক বিশ্ববিদ্যালয় আচার্য হলেও এর পরিচালনায় যাঁরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যেমন উপাচার্য, উপদেষ্টা এবং বিভিন্ন বিভাগের প্রধানরা, তাঁরা আমার সম্প্রদায়ের নয়। কাজেই, বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীর এমন মন্তব্য তাঁদের পক্ষে অপমানজনক। এনিয়ে তাঁরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত হয়েছেন।
OBC সার্টিফিকেট নিয়ে আসাম সরকার তার বিরুদ্ধে যে এফআইআর দাখিল করেছে সে নিয়ে মাহবুবুল বলেন, এফআইআর-এ অভিযোগ করা হয়েছে যে তিনি ১৯৯২ সালে প্রতারণার মাধ্যমে একটি ওবিসি সার্টিফিকেট বের করেছিলেন। আবার এফআইআরেই উল্লেখ করা হয়েছে যে সার্টিফিকেটটি ১৯৯৬ সালে বাতিল করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমার প্রয়াত ভাইয়ের মাধ্যমে ৩০ বছরেরও বেশি সময় আগে এটি পাওয়া যায়, যেটা আমি জানতাম না। বিষয়টি জানার পর আমি সেটি বাতিল করি। করিমগঞ্জের ডিসি অফিস ১৯৯৬ সালেই এই সির্টিফিকেইট বাতিলের বিষয়টি অসম সরকারকে জানিয়েছিল। তবুও রাজ্য সরকার আমার বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে। আমরা এর জবাব দেব। আমাদের আইনি দল এই বিষয়ে কাজ করছে, বলেন মহবুবুল হক।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য,অসমের করিমগঞ্জ জেলার বাসিন্দা মহবুবুল হক আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি এবং কম্পিউটার সায়েন্সে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। শুরুতে তিনি মণিপাল গ্রুপের অধীনে একটি কম্পিউটার সেন্টার শুরু করেন, তারপর শিক্ষা ক্ষেত্রে গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য ইআরডি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। গুয়াহাটিভিত্তিক এই ফাউন্ডেশনটি অসম ও মেঘালয়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে, এর মধ্যে দুটি সিবিএসই অনুমোদিত স্কুল এবং ইউএসটিএম অন্তর্ভুক্ত। ২০২২ সালে মহবুবুল হককে জনসেবায় উৎকর্ষের জন্য গভর্নর পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছিল।
মাত্র ১৩ বছরে USTM জাতীয় মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি পরিষদ তথা NAAC থেকে ‘A’ গ্রেড স্বীকৃতি অর্জন করে এবং ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে এনআইআরএফ র্যাংকিংয়ে শীর্ষ ২০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়।
মহবুবুল হক বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০১১ সালে মাত্র ছয়জন ছাত্র নিয়ে শুরু হয়েছিল। আজ সেটি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বৃহত্তম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের ২৮ টি বিভাগে ছয় হাজারেরও বেশি ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি রয়েছে।
মহবুবুল বলেন, অসমের মুখ্যমন্ত্রী শুধু আমাকেই আক্রমণ করছেন না, তিনি এমন একটি সিস্টেমকে আক্রমণ করছেন যা হাজারো ছাত্রের জন্য মঙ্গলজনক। এটি যত দূরেই গড়াক না কেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়কে আরও শক্তিশালী করার জন্য কাজ চালিয়ে যাব। আমার সহকর্মীরা এবং আমার ছাত্ররা আমার পাশে আছে, শেষের কথাটা দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেন USTM চ্যান্সেলর মহবুবুল হক